স্পেশাল রিপোর্ট ওয়েব ডেস্ক, আজকে বেদুইনের গন্তব্যস্থল এক নদী তীরবর্তী বাংলা। প্রাচীন ইতিহাস, টেরাকোটা শিল্পের কাজ, রাজাদের কাহিনী, দেবদেবীর চর্চায় মুখরিত এই গ্রাম। আপনি গ্রামের অলিতে গলিতে রন্ধে রন্ধে ইতিহাসে ছাপ খুঁজে পাবেন। পূর্ব বর্ধমান জেলায় অবস্থিত ঐতিহাসিক জনপদটির মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ । ঐতিহাসিক ভ্রমণপিপাসুদের এক অন্যতম দর্শনীয় স্থান কানলা তথা অম্বিকা কানলা । স্থাপত্য, ভাস্কর্য, বহুত্ববাদ, ঐক্য ও রূপান্তরের এক অনন্য জায়গা ।
নাম না জানা
ভাগীরথী নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত এই গ্রামটি 'অম্বিকা কানলা'। দেবী কালীর আর এক রূপ অম্বিকা। প্রাচীনকালে এখানে অম্বিকার পূজো করা হতো। তার নাম অনুসারে জায়গাটির নামকরণ করা হয় । মধ্যযুগীয় প্রসিদ্ধ নদী-বন্দর গুলির মধ্যে অন্যতম এই জনপদটি প্রাচীনকাল থেকেই শিল্প ও বাণিজ্যে সমৃদ্ধ। এটি ইতিহাসের পাতায় 'অম্বুয়া','অম্বা', 'মন্দিরের শহর' প্রভৃতি নামে পরিচিত। কামলায় অনেক মন্দির থাকায় একে মন্দির শহর বলা হয়েছে।
হইচই টইটই করে ঘুরে দেখা
সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রতীক কানলা। চৈতন্যদেব নিতানন্দদেব থেকে শুরু করে জৈনদের অম্বা, হিন্দুদের দেবতা ফিরোজ শাহ মসজিদ নসরত শাহের মসজিদ রয়েছে। মন্দির মসজিদের গায়ে টেরাকোটা শিল্প মধ্যযুগের স্থাপত্য ভাস্কর্য বহু যুগের ইতিহাস প্রমাণ করে। অনেক মন্দির এখানে আছে, তাই একে মন্দিরের পিঠস্থান ও বলা যায়।
রাজবাড়ি মাঠ/ গ্রাউন্ড -
কানলার অন্যতম ঘোরার স্থান রাজবাড়ী গ্রাউন্ড । রাজবাড়ি মাঠে অনেকগুলি মন্দির একসাথে রয়েছে।
রাজবাড়ি ঢুকতেই বাঁদিকে প্রতাপেশ্বর শিব মন্দির ।বর্ধমানের জমিদার পুত্র প্রতাপচাঁদের স্মৃতিতে এটি নির্মিত হয়েছিল ১৮৪৯ সালে ।মন্দিরটির গায়ে টেরাকোটার সূক্ষ্ম কাজ শোভা বৃদ্ধি করে। গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গ আছে। নিত্যদিন শিবের পূজা করা হয়।
প্রতাপ্পেশ্বর মন্দিরের পাশে রাসমঞ্চ। অনেক পুরনো হওয়ায় মাথার ছাদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। বিষ্ণুপুর রাসমঞ্চ থেকে ভিন্ন রূপ। দশটি খেলাম দরজা রয়েছে। রাধা কৃষ্ণের লীলা খেলার স্বরুপ হিসাবে এই রাস মঞ্চ তৈরি করা হয়।
রাজবাড়ীর মাঠের শেষ দিকে লালজী মন্দির। ১৭৩৯ সালে বর্ধমানের মহারানী ব্রজকিশোরী দেবী এটি নির্মাণ করে। ২৫ টি চুড়া বিশিষ্ট এই পঁচিশরত্ন মন্দিরে পুজিত হয় রাধা কৃষ্ণ ।এই মন্দিরেও টেরাকোটার কাজ রয়েছে। যা রাধা কৃষ্ণের প্রতিকৃতি ও বিভিন্ন কাজ অব্যক্তভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
ভারতের গোবর্ধন পর্বতের অনুকরণে নির্মিত গিরিগোবর্ধন মন্দির, লালজী মন্দিরের বাঁদিকে অবস্থিত। এই মন্দির মন্দিরের ছাদে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর অবয়ব রয়েছে। কৃষ্ণ যে গোবর্ধন পর্বত নিজের আঙুলে তুলে রেখেছিলেন তার সঙ্গে সম্পর্কিত।
এর পাশে রূপেশ্বর মন্দিরটি বর্গাকার আকৃতির । টেরাকোটা শিল্পের কাজ রয়েছে ।গর্ভগৃহে শিব লিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত।
রাজবাড়ি মাঠে অন্যতম মন্দির পঞ্চরত্ন মন্দির। পাঁচটি আলাদা আলাদা আটচলার মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরের শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। এই পাঁচটি মন্দির পাঁচটি প্রতীক হিসাবে রাজবাড়ী গ্রাউন্ডে তৈরি করা হয়।
রাজা বিজয় বৈদ্যনাথ, বিজয় বৈদ্যনাথ মন্দির নির্মাণ করেন ।আটচালার মন্দিরটির গর্ভগৃহের সামনে ত্রিখিলান প্রবেশদ্বার ও বারান্দা আছে। মন্দিরটি পোড়ামাটির ফলকে সুসজ্জিত রয়েছে। রাজা বিজয় শ্রীকৃষ্ণের স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।
১৭৫১ সালে বর্ধমান রাজ ত্রিলোক চন্দ্রের মাতা লক্ষ্মী কুমারী দেবী কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে রাধা কৃষ্ণ পূজিত হন। মন্দিরের কৃষ্ণলীলা টেরাকোটা শিল্পের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। এই মন্দিরে ২৫ টি চুড়া আছে। অত্যন্ত সুন্দর ও মুগ্ধকর এই মন্দির ।
১০৮ শিব মন্দির - রাজবাড়ি মাঠের অপরদিকে নব কৈলাস বা ১০৮ টা শিব মন্দির । ১৮০৯ সালে বর্ধমানরাজ তেজ বাহাদুর মন্দিরগুলি নির্মাণ করেন। বৃত্তাকার দুটি সাড়িতে মন্দির রয়েছে। সাদা ও কালো শিব লিঙ্গ আছে মন্দির গুলির মধ্যে। বাইরের বৃত্তে ৭৪ টি মন্দির ও ভেতরের বৃত্তে ৩৪ টি মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরটিকে নবরত্ন মন্দির বলা হয় । পুরাতন সময় এই মন্দিরগুলো ১২ জন পুরোহিত খেয়াল রাখতেন এবং তারা রোজ শিবলিঙ্গের আরাধনা করতেন ।
বলা হয় সাদা শিবলিঙ্গ ধীর স্থির ও ভোলা মহেশ্বরের রূপ প্রকাশ করে এবং কালো শিবলিঙ্গ রুদ্র তথা ভগবান শিবের ক্রোধান্বিত রূপ বলা হয়।
সিদ্ধেশ্বরী মন্দির - ১৭৪০ সালে রাজা চিত্রসেন সিদ্ধেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। চারচালা বিশিষ্ট মন্দিরটির গঠন অত্যন্ত সুন্দর। গর্ভগৃহে দেবী কালী পুজো হয় তিনি অম্বিকা নামে খ্যাত ।লোকহিত অনুযায়ী এই মন্দির আগে জৈন দেবতা অম্বার পূজা করা হতো । চিত্র সেন এটি রূপান্তরিত করে কালী মন্দির করেন। ইতিহাসবিদদের একাংশের দাবি, মাতৃসাধক অম্বরীশ এখানে দেবীর আরাধনা করতেন। এই মন্দিরের বাইরে রয়েছে রহস্যময় পুকুর। যাকে অম্বিকা পুকুর বলা হয়।
এছাড়া কানলায় বিভিন্ন ঐতিহাসিক ভ্রমণের স্থান রয়েছে। গোপালজি মন্দির ,আমতিলতা ,মহাপ্রভু বাড়ি, জগন্নাথ মন্দির ,অনন্ত বাসুদেব মন্দির, কানলা কালী মন্দির, শ্যামসুন্দর মন্দির, চৈতন্যদেবের তেতুল বৃক্ষ। চৈতন্যদেব এই তেতুল বৃক্ষের নিচেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। কানলায় অবস্থিত প্রত্যেকটি মন্দির খুব সুন্দর। মন্দির যে শুধু আধ্যাত্মিকতাই নয় কারুকার্য প্রাচীন সৃষ্টিশীলতা ও ইতিহাসের প্রতীক তা অম্বিকা কানলা এলেই বোঝা যায় ।
আপনিও শীতের ছুটিতে চলে আসতে পারেন এই অম্বিকা কানলায় । বিষ্ণুপুর টেরাকোটার কাজে অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি জায়গা। কানলা বিষ্ণুপুরের মতো প্রচার না পেলেও, বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য অসাধারণভাবে বহন করে চলেছে। এখানে বহু অজানা অচেনা স্থান ও আপনি খুঁজে বের করতে পারেন । হতে পারে আপনি সন্ধান পেলেন পাতাল গঙ্গার । যা বেদুইন পেয়েছে। অবিশ্বাস্য কিছু দেবী কাহিনীর । সময়ের সাথে সাথে অম্বিকা কানলা নিজের শিল্প স্থাপত্য কিছুটা হলেও হারিয়ে ফেলছে। কিন্তু তা ধরে রাখার দায়িত্ব সাধারণ মানুষ ও প্রশাসনের। আজ বেদুইন এই পর্যন্তই। ফিরবো নতুন এক জায়গায় ইতিহাস নিয়ে ।