কারোর কাছে পাহাড় মানে একরাশ আবেগ অনুভূতি আর মায়া।
কারোর কাছে পাহাড় মানে এক মুঠো ভালোবাসা।
কাছের কাছে পাহাড় মানে প্রকৃতির প্রেম আর আশা।
কারোর কাছে পাহাড় মানে একটু ভয় আর একটু ঘুরে দেখা।
পাহাড় শুধু পাহাড়! প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি পাহাড়! বেদুইন আজ আপনাদের নিয়ে যাবে এক মায়াময় পাহাড়ে। যাকে আমরা বলি পাহাড়ের রানী। আবার বলি মিনি সুইজারল্যান্ড অফ ইন্ডিয়া । হ্যাঁ, হয়তো ঠিক ভাবছেন আপনি। সেই পাহাড়! কাঞ্চনজঙ্ঘা যার শোভা বাড়ায়, ১০ হাজার ফুট উচ্চতা যাকে ভয়ংকরী করে তোলে, ঘুম যার সেরার সেরা, চায়ের গন্ধে যে সুন্দর, সেই তিনি দার্জিলিং। যাকে নিঃসন্দেহে বলা যায় পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর স্থান ।
নাম না জানা
হ্যাঁ, বলছি সেই দার্জিলিং নিয়েই সেই দার্জিলিং! পশ্চিমবঙ্গের দি ডেস্টিনেশন তো বটেই। কিন্তু শুধু যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তা কিন্তু নয়, পৃথিবীর অনেক মানুষই দার্জিলিং এর অপরূপ রূপ দেখতে আসে। দার্জিলিং এর ইতিহাস বা পাতিহাঁস না বললেও এর নামের একটা বর্ণাঢ্য আছেই। দার্জিলিং নামটি তিব্বতীয় শব্দ থেকে এসেছে। ‘দোর্জে’ (দার্জি) অর্থ “বজ্রধ্বনি” এবং ‘লিঙ্গ’ (লিং) অর্থাৎ “একটি জায়গা বা জমি”। সুতরাং দার্জিলিংকে বজ্রদেশ বলা হয়েছে। ইন্দ্রের রাজদণ্ড নাকি দার্জিলিং। আবার শোনা যায় দার্জিলিং শব্দটি সংস্কৃত ভাষা ‘দুর্জয় লিঙ্গ ‘ থেকে এসেছে। যার অর্থ “অদম্য ক্ষমতার অধিকারী শিব যে হিমালয় শাসন করে “।
হইচই টইটই করে ঘুরে দেখা
কাঞ্চনজঙ্ঘা, শীত, টয়ট্রেন, মিরিক, মনেস্ট্রি, চা বাগান, সব মিলে প্রকৃতি যেন নিজের হাতে সমস্ত জায়গাটাকে সাজিয়েছে। ক্লান্তি, চিন্তা, চাপ, অসুখ সারাইয়ের একমাত্র ঔষধ। অলীক কল্পনা, পাহাড়ি গন্ধ, শীতের আমেজে ঘুরে দেখা কিছু স্থান।
টাইগার হিল –
দার্জিলিং এর সেরার সেরা টাইগার হিল। ২৫৯০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এক অনন্য জায়গা। এখান থেকে মাউন্ট এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘার পর্বতের অপরূপ সৌন্দর্য লক্ষ্য করা যায়। সূর্যোদয়ের আলোকরশ্মিতে ঝলমল করে ওঠে কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফ থেকে প্রত্যক্ষ করা মানুষের দৃষ্টি পর্যন্ত। দার্জিলিং এর চৌরাস্তা মল থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত টাইগার হিল খানিকটা সময় নেবে আপনার। কিন্তু ভোরের সৌন্দর্য আপনার অপেক্ষার একটা মিষ্টি দৃশ্য উপহার দেবে।
রক গার্ডেন –
সুন্দর ঝর্না, ফুলের বাগান, পাহাড়ের গা ঘেঁষে থাকা বেঞ্চে পছন্দের মানুষের সঙ্গে বসা, গার্ডেনের প্রতিটা মোড় পেরিয়ে অসাধারণ ভিউ রক গার্ডেনের শোভা বাড়ায়। লয়েডস বোটানিক্যাল গার্ডেন, গঙ্গা মায়া পার্ক, গোর্খা লোকনৃত্য পর্যটনদের হৈ হৈ করে ঘুরে দেখার আনন্দ দেয়।
বাতাসিয়া লুপ –
মেঘের দেশ বাতাসিয়া লুপ। ঘুম স্টেশন থেকে ট্রয় ট্রেনে করে দার্জিলিং যাওয়ার পথে মাঝখানে পরে বাতাসিয়া লুপ। দার্জিলিং হিমালয়াস রেলওয়ে এখানে ৩৬০ ডিগ্রি স্পাইরাল রেলওয়ের তৈরি করে পর্যটকদের অপরূপ দৃশ্য মোহিত হওয়ার আনন্দ দেয়। ১৯১৯ সালে এই বাতাসিয়া লুপ তৈরি হয়। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার দৃশ্য আপনার মনের মনিকোঠায় সর্বদা রঙিন হয়ে থাকবে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন যুদ্ধে নিহত গোর্খা শহিদ বীর সৈনিকদের শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৯৫ সালে এটির উদ্বোধন করা হয়। এক গোর্খা সৈনিকের ব্রোঞ্জ মূর্তি এখানে শোভা পাচ্ছে।
পিস প্যাগোডা –
দার্জিলিং এর অন্যতম স্থান পিস প্যাগোডা ও জাপানিজ টেম্পেল। চৌরাস্তা মল থেকে খানিক দূর এই অবস্থিত। ধবধবে সাদা বৌদ্ধস্তূপ যা শান্তি , স্বচ্ছতা ও একতার বার্তার প্রচারে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালে নিপ্পোনজান-ম্যাওহজি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা নিচিদা ফুজি এই স্তুপের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই স্তুপটির উচ্চতা ২৮.৫ মিটার এবং এটি দার্জিলিংয়ের সর্বোচ্চ স্তুপ। এই স্তুপের চারপাশে চারটি চকচকে এবং সোনার পালিশ করা বুদ্ধের মূর্তি রয়েছে। এছাড়াও, স্তুপের দেয়ালে গৌতম বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের কাহিনী আটটি বেলেপাথরের প্লেটে খোদাই করা রয়েছে। পিস প্যাগোডার পাশে একটি জাপানি বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে। এটি নিপ্পোনজান ম্যাওহজি বৌদ্ধ মন্দির নামেও পরিচিত। এখানে প্রতিষ্ঠাতা ফুজি গুরুজির ছবি এবং একটি বুদ্ধের মূর্তি রয়েছে।
মিরিক –
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মনোরম জলবায়ু , মিরিক চা বাগান, পাহাড়ি নদী, মন্দির, মনেস্ট্রি, ফলের বাগান, মিরিক লেক, টিংলিং ভিউপয়েন্টের সহজলভ্যতায় সেজে উঠেছে মিরিক । দার্জিলিং এর আরও একটি মনোরম গন্তব্যস্থল। মিরিক নামটি লেপচা শব্দ নিরর্ক থেকে এসেছে যার অর্থ আগুনে পোড়া জায়গা। শোনা যায় বহির দস্যুদের অত্যাচারে মিরিক জায়গাটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায় যেন আগুনে পুড়ে ঝলসে যায়। তারপর প্রকৃতি আবার নিজের মতো করে মিরিককে সাজিয়ে নেয়।
দার্জিলিং মল –
দার্জিলিং জেলার হটস্পট দার্জিলিং মল বা চৌরাস্তা মল। এক টুকরো পাহাড়ি শহর। চারটি রাস্তা এখানে এসে মিলিত হওয়ায় একে চৌরাস্তা বলা হয়। রেস্টুরেন্ট, গিফটের দোকান, বইয়ের দোকান, চায়ের দোকান, মোমো ও নোডুলসের গন্ধ, কিউরিও শপ, সবমিলিয়ে একখন্ড ব্যস্ত দার্জিলিং। সোনালী রোদ্দুর, সুন্দর ঝর্না, পাখিদের কোলাহল, চারিপাশে পুরনো স্থাপত্যের ঘরবাড়ি তুলে ধরে দার্জিলিং এর ইতিহাসের কথা। চৌরাস্তার কাছেই রয়েছে সেন্ট অ্যান্ড্রিউ চার্জ, অবজার্ভেটরি হিল, মহাকাল মন্দির মতো ঘোরার জায়গা।
দার্জিলিংয়ে ছোট ছোট গ্রামও খুব সুন্দর ভাবে শোভা পায়। লেপচাজগৎ, ডলি মনেস্ট্রি, ঘুম মনেস্ট্রি, দার্জিলিং চিড়িয়াখানা, দার্জিলিং মিউজিয়াম, হ্যাপি ভ্যালি চাবাগান, তিনচুলে, সেভোক, কার্শিয়াং, কার্নেস ব্রিজ, ডাউ হিল, ঈগলস ট্রাক ভিউ পয়েন্ট মত জায়গা গুলিও রয়েছে। আপনি দার্জিলিং ঘুরে শেষ করতে পারবেন কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ আছে। যারা অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন তারা রোপ ওয়ে, রোপ স্লাইড, বোটিংয়ের আনন্দ নিতে পারেন।
শেষের কথা –
পাহাড়ের রানী আজও রানীর মতই নিজেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আকর্ষণীয় করে রেখেছে। নদী ,পাহাড় ,মেঘ ,রোদ্দুর মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে । রাতের শান্ত নিস্তব্ধ পাহাড়ি পরিবেশ আপনাকে এক সুন্দর অনুভূতি দেয়। পাহাড়ের কোলে একটু স্বস্তি পেতে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন দার্জিলিংয়ের অলিতে গলিতে । আবিষ্কার করতে পারেন নতুন কোন জায়গায়ও । আজ এই পর্যন্তই বেদুইনের দার্জিলিং কথা ।