বেদুইন আজ বলবে আর এক লাল মাটির দেশের কথা। যার উৎপত্তি ৭০০ শতকের আগে । এখানে মল্ল রাজারা রাজত্ব কায়েম করে গেছেন। টেরাকোটা শিল্পের বুননে যে সেরার সেরা। যেই লাল মাটির পথের আঁকে বাঁকে ইতিহাসের ছোঁয়া । এখানের বালুচরি সূক্ষ্ম কারুকার্য আপনাকে মোহিত করে তোলে। একাধিক মন্দির যে জায়গার শোভা বাড়ায় । যেখানকার মানুষের হাতের জাদুকরী আপনাকে রোমাঞ্চিত করে। শাস্ত্রীয় ঘরানার গান আপনার গভীরতা বাড়ায় । মাটির পুতুলের সৌন্দর্য আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে । সেই শিল্প স্থাপত্য কারুকার্যময় জায়গা বিষ্ণুপুর । সৃষ্টি থেকে আজ অবধি যে নিজেই এক বিস্তর ইতিহাস ।
নাম না জানা
বাঁকুড়া জেলায় অবস্থিত বিষ্ণুপুর রাজরাজা, মুঘল সম্রাট, বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, শিল্প, স্থাপত্যের এক ঐক্য পিঠস্থান। বিষ্ণুপুর আগে মল্লভূমি নামে পরিচিত ছিল। ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে এখানে মল্ল রাজারা রাজত্ব শুরু করেছিলেন। প্রথম রাজা ছিলেন আদি মল্ল। পরবর্তীকালে কয়েকশো বছর ধরে জয় মল্ল, হাম্বির মল্ল দেব বিষ্ণুপুরে শাসন চালান। রঘুনাথ সিংহ, বীর সিংহ, দুর্জন সিংহ, গোপাল সিংহ, চৈতন্য সিংহ প্রমুখ রাজারা বিষ্ণুপুরে ধর্ম, মন্দির, দুর্গ ,বাঁধ তৈরি করেন। রাজা আদি মল্ল বিষ্ণুর মহান উপাসক ছিলেন। তিনি বিষ্ণুর নাম অনুসারে এই জায়গায় নামকরণ করেন বিষ্ণুপুর।
১৫৮৬ থেকে ১৬২১ মুঘল-আফগান লড়াইয়ে মুঘল সম্রাটের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন মল্লরাজ বীর হাম্বীর। সেই সময় থেকেই মুঘলদের সাহায্যে কামান তৈরির পল্লি গড়ে ওঠে বিষ্ণুপুরে। নাম দেওয়া হয় কামানটোলা। কর্মকার শ্রেণির মানুষেরা আসতে থাকেন। আসেন রাজনর্তকী লালবাঈ। তানসেনের দৌহিত্র বাহাদুর খাঁ। দ্বিতীয় দিল্লির আখ্যা পেতে থাকে বিষ্ণুপুর। এখানে ২৫ টির বেশি দর্শনীয় মন্দির রয়েছে তাই একে মন্দির শহর বলা হয়।
হইচই টইটই করে ঘুরে দেখা
ইউনেস্কোর হেরিটেজ তকমা পেয়েছে বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার মন্দির গুলি । এটি প্রাচীন বাংলার শিল্প ও সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। গ্রামীন হস্তশিল্প, ধাতুশিল্প, মৃৎশিল্প, বিখ্যাত বালুচরী শিল্প বিষ্ণুপুরের ওলিতে গলিতে দেখা যায়। যতীন্দ্রনাথ মিত্র মুস্তাফির লেখা দ্য রুইনস অফ বিষ্ণুপুর বইতে এই জায়গার বিস্ময়কর ইতিহাস লেখা আছে। ১৯৪০ সালে জন আর্থার সাহেব বইটি প্রকাশ করেছিলেন। এই বই বিষ্ণুপুরের ইতিহাসকে আরো অর্থবহ করে তোলে। আপনিও সংগ্রহ করতে পারেন বইটি ।
রাসমঞ্চ
বিষ্ণুপুরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান রাসমঞ্চ । সবুজের মধ্যে নানা রঙের ফুলের মাঝে বিশাল একটি বেদী ওপর মঞ্চ । পিরামিডের আকৃতির এই মঞ্চটি পোড়া ইটের তৈরি। ১৬০৭ সালে মল্ল রাজা বীর হাম্বির ৩৫ ফুট উঁচু ও ৮০ ফুট চওড়া এই রাসমঞ্চটি নির্মাণ করেন। রাসমঞ্চের গর্ভগৃহ খিলান যুক্ত। বাইরের শাড়িতে ৪০ টি খিলান আছে। খিলানের গায়ে পোড়ামাটির পদ্ম ও পূর্ব দেয়ালে বিষ্ণুপুর গায়কদের স্মৃতি সমৃদ্ধ টেরাকোটার প্যানেল রয়েছে।
জোড়বাংলা
বীর হাম্বীরের পুত্র রঘুনাথ সিংহ ১৬৫৫ খ্রীষ্টাব্দে এটির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটি দৈর্ঘ্যে ১১.৮ মিটার, প্রস্থে ১১.৭ মিটার ও উচ্চতায় প্রায় ১০.৭ মিটার।গঠন বৈচিত্রে ও উৎকৃষ্ট পোড়ামাটির আলংকারিক কারুকার্য বৃদ্ধ জোড়বাংলা মন্দিরটি। এটি কেষ্টরায় মন্দির নামেও বিখ্যাত। উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত, দক্ষিণ মুখী মন্দিরটি ‘জোড়বাংলা’ শৈলীর। দুটি ‘দোচালা’ বা ‘এক বাংলা’ পাশাপাশি জোড়া থাকলে বলা হয় জোড়বাংলা। এতে মন্দিরের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পায়। এই স্থায়িত্বকে আরও দৃঢ় করার জন্য আলোচ্য জোড়বাংলা মন্দিরের উপরে একটি চারচালা ‘রত্ন’ বসানো হয়েছে। মন্দিরটির গর্ভগৃহে শ্রীরাধিকা ও শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি রয়েছে।
মদনমোহন মন্দির
মদনমোহন মন্দির বিষ্ণুপুরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। ৪৯ তম মল্ল রাজা বীর হাম্বির মদনমোহন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে ১৬৯৪ সালে মল্ল রাজা দুর্জন সিংহ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পুরানে কথিত আছে ৫৫ তম মল্ল রাজা শ্রী গোপাল সিংহ মদনমোহনের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। মন্দিরের দৈর্ঘ্য প্রস্থ ১২.২ মিটার এবং উচ্চতা ১০.৭ মিটার। মন্দিরের দেওয়ালে টেরাকোটা কাজের মাধ্যমে কৃষ্ণনীলা দশাবতার ও অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনী কাহিনীর বিভিন্ন দৃশ্য রূপায়িত করা আছে।
রাধাগোবিন্দ মন্দির
বিষ্ণুপুরের প্রাচীন মন্দির গুলির মধ্যে অন্যতম রাধাগোবিন্দ মন্দির। এটি রাধামাধব মন্দির নামেও পরিচিত। ১৭৩৭ সালে মল্ল রাজার আমলে রাণী চুড়ামণির নির্দেশে এই মন্দির নির্মাণ হয়েছিল। আবার অনেকের ধারণা রাজা বীর সিংহের স্ত্রী রানী শিরোমনি দেবী এই মন্দির নির্মাণ করেন। লাল পাথর দ্বারা এই মন্দির নির্মাণ হয়েছিল। মন্দিরের গায়ে বিভিন্ন স্থাপত্য কলার নির্দেশন পাওয়া যায়। রামায়ণ-মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্র খোদাই করা আছে। প্রাচীনকালে এই মন্দিরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পূজা করা হতো, কিন্তু বর্তমানে এই মন্দিরের কোন দেবী মূর্তি নেই।
দলমাদল কামান
বর্গীদের যম বলা হয় দলমাদল কামানকে। এটি ১২ ফুট ৫ ইঞ্চি দীর্ঘ, পরিধি ১১ ইঞ্চি। জগন্নাথ কর্মকার নামে এক শিল্পী এটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে মল্লভূমির রাজা গোপাল সিংহ বর্গীদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে এই কামান বানান। কথিত আছে এই কামান স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ মদনমোহন রূপে চালিয়েছিলেন। বাংলার বুকে এই কামান বীরত্বের প্রতীক ।
রাধাশ্যাম মন্দির
লালচে মাকড়া পাথরের মন্দিরটি ১৭৫৮ সালে মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ নির্মাণ করেন। মন্দিরের মুখে সুন্দর নহবতখানা রয়েছে। এই নহবতখানায় একসময় নিত্য গানবাজনার আসর বসত। চতুষ্কোণ ছাদবিশিষ্ট মন্দিরের চুড়োয় গম্বুজআকৃতি বিষ্ণুপুরের বাকি মন্দিরের থেকে অনেকটাই আলাদা। মন্দিরের অন্দরমহলে তুলসীমঞ্চ, রান্নাঘর ও নাটমঞ্চ। রয়েছে রাধেশ্যাম, গৌড়নিতাই ও জগন্নাথের মূর্তি । আজও পূজাপাটের চল আছে এই মন্দিরে।
মৃন্ময়ী মন্দির
এটি বিষ্ণুপুর শহরের একটি প্রাচীনতম মন্দির। মল্লরাজ শ্রীমন্ত জগৎমল্ল দেব ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন মৃন্ময়ী মন্দির। এখানে পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম দুর্গাপূজা হয়। প্রাচীন বলিনারায়ণী মতে আয়োজিত এই পূজার আচার প্রচলিত দুর্গাপূজার আচার অনুষ্ঠান থেকে কিছুটা ভিন্ন। এই পূজায় মূর্তি বিসর্জন হয় না। প্রতি বছর ঘট স্থাপন করে পটে আঁকা দুর্গার পূজা হয়।
এছাড়াও বিষ্ণুপুরে বহু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। রাজা বীর সিংহ লালবাঁধ, কৃষ্ণ বাঁধ, গণতাতবাঁধ, যমুনাবাঁধ, কালিন্দীবাঁধ, শ্যামবাঁধ ও পোকাবাঁধ নামে সাতটি বড় বড় জলাধার নির্মাণ করেন, যা অত্যন্ত সুন্দর ও প্রকৃতিময়ী। এখানে লালাজি মন্দির খুব সুন্দর। আপনার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে পরশুরা গ্রাম থাকতেই পারে যা বিভিন্ন চিত্র শিল্পকলার জন্য বিখ্যাত। পাথরের দোতলার রথ, শ্যামরাই মন্দির, নন্দলাল মন্দির, কালাচাঁদ মন্দির, মল্লেশ্বর মন্দির, যুগল কিশোর মন্দির, বিষ্ণুপুর মিউজিয়াম আপনাকে বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ইতিহাসের কাছে নিয়ে যাবে ।
শেষের কথা
বিষ্ণুপুর ঐতিহ্য, শিল্প, স্থাপত্যকলার মিলন স্থল। টেরাকোটা শিল্পের কাজে মন্দির শহরটি এক অনন্য জায়গা করে নিয়েছে মানুষের মনে। আপনি শীতের ছুটিতে ঘুরে আসতে পারেন বিষ্ণুপুরের ঐতিহ্যর সফরে। কিনতে পারেন বিশ্ব বিখ্যাত বালুচরী শাড়ি। আপনার ঘরের শোভা বাড়াবে বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত মাটির ঘোড়া, পুতুল ও বিভিন্ন মাটির কারুকার্য করা জিনিস। এক অনন্য সাধ পেতে ঘুরে আসুন বিষ্ণুপুরে, ঢু মারতে পারেন বনলতায়। আজ বেদুইন এই পর্যন্তই।