লাল পাহাড়ের দেশে যা সোনা মাটির দেশে যা ইতাক তোকে মানাইছে না রে, ইক্কেবারে মানাইছে না রে ।।
এই গানটা শুনলেই মনে পড়ে যায় লাল মাটি, পাহাড়, সবুজ আর প্রকৃতির ভরা এক জায়গা । বেদুইন আজ যাবে লাল মাটির দেশে। পাহাড়, জঙ্গল, বাঁধ ,সরোবর নিয়ে অপূর্ব প্রাকৃতিক রূপসী সে। ভাষা আন্দোলনের উৎস যে মাটি থেকে। ছৌ নাচের তালে সে সেরার সেরা ।সবুজে ঘেরা অরণ্য যার মাধুর্য তুলে ধরে । গ্রাম্য প্রকৃতির সৌন্দর্য আকর্ষণ করে । আজ সেই পুরুলিয়া। পশ্চিমবঙ্গের এক টুকরো সমাজ, সংস্কৃতি, আদিবাসী, মুখোশ নাচের ঐক্য স্থান ।
নাম না জানা
পুরুলিয়া জেলা সৃষ্টির একটা বিস্তর ইতিহাস রয়েছে । ভাষা আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, সাঁওতাল বিদ্রোহ, চুয়াড় বিদ্রোহ, আদিবাসী বিদ্রোহের স্বাক্ষী এই পুরুলিয়া । ১৭৬৭ সালে ব্রিটিশদের অনুপ্রবেশে পুরুলিয়ার যথেষ্ট অবদান রয়েছে । কথিত আছে চুয়ার বিদ্রোহের ফল স্বরূপ পুরুলিয়া জেলার জন্ম হয়েছিল ।
প্রত্যেকের নামের ইতিহাস আছে, পুরুলিয়া তার ব্যতিক্রম নয়। “পেরুয়া” বা “পেরুলা” থেকে পুরুলিয়া শব্দটি এসেছে । “পেরুল” একটি দ্রাবিড় শব্দ যার অর্থ “নদী বা জল” । আবার দ্রাবিড় ভাষায় “পারু” শব্দের অর্থ “নুড়ি বা পাথরের চাঁই ” এবং “লা” শব্দের অর্থ “মধ্যে” । অর্থাৎ সব মিলিয়ে পুরুলিয়া কে পাথুরে গ্রাম বলা যায়। প্রাচীনকালে পুরুলিয়া বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। যেমন পশুভূমি, বজ্রভূমি, আটবিদে, ঝারিখন্ড, জঙ্গলমহল ও মানভূম । ইতিহাসের পাতা বলে পুরুলিয়ায় “মান” রাজবংশের প্রতিপত্ত ছিল। সেই কারণেই পুরুলিয়া বিশেষভাবে মানভূম নামে পরিচিত ছিল।
হইচই টইটই করে ঘুরে দেখা
নদী, পাহাড়, জঙ্গল প্রকৃতির সব উপাদানই এখানে একত্রে রয়েছে। কংসাবতী, দামোদর, সুবর্ণরেখা, কুমারী যেমন আপনাকে আকর্ষিত করবে ঠিক তেমনি অযোধ্যা, ময়ূর পাহাড় আপনাকে রোমাঞ্চিত করবে। নদীর আঁকাবাঁকা পথ, জলপ্রপাত নিয়ে যাবে গভীর ভাবনায় ।
অযোধ্যা পাহাড়
পুরুলিয়ার অন্যতম দর্শনীয় স্থান অযোধ্যা পাহাড়। বেশিরভাগ পর্যটন এই অযোধ্যা পাহাড় দেখার উদ্দেশ্যে পুরুলিয়া আসেন। ৮৫৫ মিটার উঁচু পাহাড়টি পুরুলিয়া জেলার বাঘমুন্ডি অঞ্চলে অবস্থিত । পুরানে কথিত আছে রাম ও সীতা বনবাসের সময় অযোধ্যা পাহাড়ে এসেছিলেন। এখানে এসে সীতা তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লে, রাম মাটি খুঁড়ে জল বার করে আনেন। এখানকার আদিবাসীরা অযোধ্যা পাহাড়কে ঘিরে শিকার উৎসব পালন করেন। অযোধ্যার হিল টপে আপনারা পায়ে হেঁটেই যেতে পারেন এবং চারিপাশের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।
গড় পঞ্চকোট
পুরুলিয়া শহর থেকে ষাট কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গড় পঞ্চকোট একটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থান । এই অঞ্চল শিখর রাজবংশের রাজধানী ছিল। এখান থেকে আশেপাশের গ্রামাঞ্চলের সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়। প্রধান আকর্ষণ ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গ, পঞ্চরত্ন মন্দির, কঙ্কালী মাতার মন্দির, পঞ্চকোট পাহাড়,ও রাস মন্দির। সময়ের সাথে সাথে ঐতিহাসিক স্থাপত্য গুলি ভগ্নপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। শীতের আমেজে পিকনিক এবং সূর্যাস্ত দেখার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।
রাকাব অরন্য
পুরুলিয়ার কেশরগড় রাকাব অরণ্যের জন্য বিখ্যাত। ১৬ ক্রোশ পর্যন্ত বিস্তৃত এই অরণ্যভূমি। কথিত আছে রাজা মহারাজারা এই অরণ্য অঞ্চলে স্বীকার করতে আসতেন। শাল, পলাশ, মহুয়া, পিয়ালী,বহড়আ, কৃষ্ণচূড়া গাছের সমারহে এক সুন্দর স্থান। ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মানভূম জেলার মানুষরা এই অঞ্চলে বিদ্রোহ শুরু করে। কথিত আছে কেশরগড় এর মহারাজা ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হলে তাকে এই জঙ্গলে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ।
জয়চন্ডী পাহাড়
পুরুলিয়া থেকে প্রায় ৪৪ কিলোমিটার দূরে রঘুনাথপুরে অবস্থিত জয়চন্ডী পাহাড়। এটি খুব জনপ্রিয় একটি ট্রাকিং স্পট । এই পাহাড়টি যোগীঢাল, চন্ডী, ঘড়ি, রাম সীতা প্রভৃতি নামে পরিচিত। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ছবি হীরক রাজার দেশে ছবিটির শুটিং এখানে হয়েছিল। পাহাড়ের ওপর রয়েছে জয়চন্ডী মন্দির ও বজরং মন্দির। ৫০০ টি বেশি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার অভিজ্ঞতা আপনাকে রোমাঞ্চিত করবে।
চড়িদা গ্রাম
পুরুলিয়া মানেই ছৌ নাচ আর ছৌ নাচ মানেই পুরুলিয়া । অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এই গ্রামটি পুরুলিয়ায় বেড়াতে এলে আসতেই হয় । বাঘমুন্ডি শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে এই গ্রামটিতে ছৌ নাচের মুখোশ তৈরি করা হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই গ্রামের বাসিন্দারা ছৌ মুখোশ তৈরি করে থাকে । গ্রামটিতে এলে আপনি বিভিন্ন রকমের রংবেরঙের ছোট বড় মুখোশ দেখতে পাবেন । বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে ছৌ নাচকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। চড়িদা গ্রামকে মাস্ক মেকিং ভিলেজ হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।
দেউলঘাটা
পুরুলিয়ার অন্যতম দর্শনীয় স্থান দেউলঘাটা। এই দেউলঘাটায় এককালে অনেক মূর্তি ছিল। কিন্তু বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেই মূর্তি আর নেই, জায়গাগুলিও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। পাল ও সেন যুগে দেউলঘাটার মন্দিরগুলি নির্মিত হয়েছিল । হাজার হাজার বছরের রহস্য ঘনীভূত হয়ে আছে মন্দিরের ইট কাঠ পাথরের মধ্যে । ২৫০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৫০ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট একটি বৃহৎ বেদীর ওপর দাঁড়িয়ে আছে দেউলটি । মন্দির গর্ভে চতুর্ভুজা সিংহবাহী দেবী দুর্গার মূর্তি রয়েছে। আরেকটি শিব দুর্গার মূর্তি রয়েছে।
মুরগুমা
পুরুলিয়ার অন্যতম দর্শনীয় স্থান মুরগুমা। তিন দিক জলধারার মাঝে সবুজ বনানী ক্ষেত্র অপরূপ প্রাকৃতিক সভা তুলে ধরে। ছোট ছোট পাহাড়ে ঘেরা জলাশয় এক অনন্য দৃশ্য ধরা দেবে। মুরগুমার অন্যতম আকর্ষণ হল সুইসাইড পয়েন্ট পাহাড়ের শীর্ষে অবস্থিত এই ভিউ পয়েন্ট আপনাকে রোমাঞ্চিত করবে। শীতের মরশুমে পিকনিক করার অন্যতম স্থান। ছয়টি ঋতুতে ছয়টি রূপে নিজেকে সুন্দর করে তোলে মুরগুমা ।
পুরুলিয়াতে বিভিন্ন জলপ্রপাত আপনাকে স্রোতের মতো আনন্দ দেবে। যেমন বামনী,টুরগা,তেল্কুপি বিখ্যাত। এছাড়াও মুরাডি বাঁধ, ময়ূর পাহাড়, মার্বেল লেক, লহরিয়া ড্যাম, সুরুলিয়া, দুর্গা বেড়া, পাখি পাহাড়, কাশিপুর রাজবাড়ি, বিহারীনাথ মন্দির, খাইবার বেড়া, সীতাকুণ্ড প্রভৃতি জায়গায় আপনি ঢু মেরে আসতে পারেন।
পুরুলিয়ায় যে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ঐক্যই দেখা যায় তা নয় । এখানে ছৌ নাচ ,আদিবাসী উৎসব থেকে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ সবই উদযাপন হয়। টুসু, ভাদু, করম পরব ইত্যাদি আঞ্চলিক উৎসব লক্ষ্য করা যায়। টুসু উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ টুসু সঙ্গীত আঞ্চলিকভাবে জনপ্রিয় । ভারতীয় আদিবাসী যুদ্ধ-নৈত্য ছৌ নাচ বিশেষভাবে প্রাধান্য পায় পুরুলিয়ার। শহরের ধুলো ধোঁয়া মাখা ক্লান্ত পরিবেশ থেকে ছুটি পেতে ঘুরে আসতে পারেন পুরুলিয়ায়। সঙ্গে দেখতে পারেন ছৌ নাচ ও টুসু সঙ্গীতের মত আঞ্চলিক বিষয়গুলি। আজকে বেদুইনের কথা এই পর্যন্তই।