বেদুইন আজ বলবে এক নবাবী শহরের কথা। ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত এই নবাবী শহর বাংলার ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। যেখানে রাজ রাজাদের শাসন থেকে নবাবদের প্রতিপত্তি আর ইংরেজদের প্রধান আস্তানা। ইতিহাসের পাতায় এই জায়গার অবস্থান স্বর্ণাক্ষরিত। সময়ের সাথে সাথে নবাবিয়ানা থেকে ইংরেজদের স্থাপত্য শিল্পের অনন্য মেলবন্ধনের জায়গা। এক সময় বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী ছিল। সতেরো শতকে এর অবস্থান সেরার সেরা। পালাবদলের ইতিহাস থেকে ইংরেজদের শাসনের সূচনার সাক্ষী এই জায়গার আকাশ, বাতাস, মাটি। সময়ের ইতিহাসের এক অনন্য উদাহরণ মুর্শিদাবাদ। বেদুইন আপনাকে নিয়ে যাবে মুর্শিদাবাদের অলিগলির ইতিহাস ঘোরাতে।
নাম না জানা
প্রাচীনকালে সবথেকে ধনী ও প্রাচুর্যপূর্ণ শহর ছিল মুর্শিদাবাদ। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে এই শহর গুরুত্বপূর্ণ। মুর্শিদাবাদের নামের ইতিহাসও বড় জটিল, সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন নামে লেখা আছে বিভিন্ন জায়গায়। আইন-ই-আকবারি থেকে জানা যায় বাদশা আকবরের রাজত্বকালে বাংলার সুবাদার সৈয়দ খাঁর নাম অনুসারে মুর্শিদাবাদকে সৈদাবাদ বলা হত। ষোলো শতকে মুখসুয়া খাঁ, রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে আসেন সেখান থেকে নাম হয় মুখসুদাবাদ। সিরাজউদ্দৌলার ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর ১৭০৪ সালে বাংলার নবাব হন মুর্শিদকুলি খাঁ। দিল্লির সম্রাট ঔরঙ্গজেবের অনুমতি পেয়ে তিনি মুখসুদাবাদ নাম পরিবর্তন করেন। তিনি নিজের নাম অনুসারে এই জায়গার নামকরণ করেন মুর্শিদাবাদ। সয়েরউল-মুতাক্ষরীণ এ উল্লেখ আছে কুলাডিয়া বলে। এছাড়াও মুর্শিদাবাদ মুবারকবাদ, মুহাম্মদাবাদ, মুয়াজ্জামাবাদ নামে পরিচিত ছিল।
হইচই টইটই করে ঘুরে দেখা
১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধের স্বাক্ষী মুর্শিদাবাদ। রাজ রাজাদের সময়কালে মন্দির থেকে শুরু করে নবাব আমলের মসজিদ, ইংরেজ আমলের স্থাপত্য শিল্পের এক ঐক্য পিঠস্থান। বাংলার এক অনন্য জায়গা মুর্শিদাবাদ এখানে আপনি ইতিহাসের গন্ধে মাখা বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখতে পারেন। বেদুইনের লেখায় রয়েছে মুর্শিদাবাদের বিশেষ কিছু জায়গা।
হাজার দুয়ারী
মুর্শিদাবাদের এক অনন্য স্থান হলো হাজারদুয়ারি। গ্রীক ও ইতালীয় শৈলীতে নির্মিত প্রাসাদটির উচ্চতা ৮০ ফুট। মীরজাফরের বংশধর নবাব নাজিম হুমায়ুন যাহো ৪১ একর জায়গার ওপর এই বিশাল স্থাপত্যটি তৈরি করেন। এই প্রাসাদের হাজারটি দরজা থাকায় একে হাজার দুয়ারী বলা হয়। উজ্জ্বল নিদর্শনটি বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের রক্ষণাবেক্ষণ করছে। প্রাসাদটিতে ১১৪ টি ঘর ও আটটি গ্যালারি রয়েছে। এখানে আপনি বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুদ্ধাস্ত্র দেখতে পাবেন।
কাঠগোলা বাগান
হাজারদুয়ারি থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কাঠগোলা বাগান বাড়ি। ১৮৭৩ সালে এই জায়গাটি কিনে বাগানবাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন জিয়াগঞ্জের রাজা লক্ষ্মীপৎ সিং দুগর ও ধনপতি সিং দুগর। প্রচলিত মতানুযায়ী এই বাগানবাড়িতে কাঠের গোলা ছিল বলে এর নাম হয় কাঠগোলা। আবার শোনা যায় এই বাগানে বিখ্যাত কাঠগোলাপের চাষ হতো তাই এর নাম হয়েছে কাঠগোলা। কাঠগোলা বাগানে একটি বিশাল প্রাসাদ, একটি প্রাচীন সংগ্রহশালা, চিড়িয়াখানা, গোপন সুরঙ্গ পথ, আদিনাথ মন্দির, শ্বেতপাথর বাঁধানো পুকুর, জলসাঘর রয়েছে। পর্যটকরা এক অনন্য রাজ প্রাঙ্গণের দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।
মতিঝিল পার্ক
মুর্শিদাবাদের অন্যতম দর্শনীয় স্থান মতিঝিল পার্ক। প্রায় এক হাজার পঞ্চাশ বিঘা জমি আড়াইশো বছরের পুরনো ইতিহাসকে বহন করছে । নবাব আলীবর্দি খানের জামাতা নাওজেশ মহম্মদ স্থান এটি তৈরি করেন। সিরাজউদ্দৌলা, মুর্শিদকুলি খাঁ, আলিবর্দি খাঁ, ঘসেটি বেগম, লর্ড ক্লাইভ, মির জাফর, ওয়াটসন, জগৎ শেঠ, ওয়ারেন হেস্টিংস প্রমুখ ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত এই জলাশয় এর ঐতিহাসিক সাক্ষী। বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রূপরেখা তৈরি হয় মতিঝিল প্রাসাদ থেকে। যা সময়ের সাথে সাথে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ অশ্বক্ষুরাকৃতির জলাশয় আপনাকে আনন্দ দেবে।
কাটরা মসজিদ
মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত মসজিদ হল কাটরা মসজিদ। বাংলা নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে মসজিদের সিঁড়ির নিচে মুর্শিদকুলি খাঁর মৃতদেহ শায়িত রয়েছে। ইসলামী স্থাপত্য রীতিতে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদের পাশে বিশাল একটি বাজার বসত, বাজারকে ইসলামী ভাষায় কাটরা বলা হয় সেই থেকে এটি কাটরা মসজিদ বা বাজার মসজিদ নামে পরিচিত। মসজিদের সামনে ৭০ ফুট উচ্চতা ও ২০ ফুট চওড়া মিনার রয়েছে।
নিজামত ইমামবাড়া
ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত নিজামত ইমামবাড়া বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ নবাব নিজাম মনসুর আলী খান ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে এই বিশাল নিজামাত ইমামবারা নির্মাণ করেন। ইমামবাড়াটি লম্বায় ৬৮০ ফুট এবং সেন্ট্রাল ব্লকটি প্রায় ৩০০ ফুট লম্বা। অত্যন্ত সুন্দর ইসলাম স্থাপত্য কলা, রীতিতে এই ইমামবাড়াটি নির্মাণ করা হয়। বাংলা তথা ভারতের সবচেয়ে বড় ইমামবাড়া নামে পরিচিত। তৎকালীন সময়ে নির্মাণে ৬ লাখের বেশি স্বর্ণ মুদ্রায় লেগেছিল।
নশিপুর রাজবাড়ী
মুর্শিদাবাদের জনপ্রিয় একটি পর্যটক কেন্দ্র হলো নশিপুর রাজবাড়ি। ১৮৬৫ সালে রাজা কীর্তি চন্দ্র সিংহ বাহাদুর রাজবাড়ীটি নির্মাণ করেন । এটি দেবী সিংহের রাজবাড়ী নামে বিশেষ পরিচিত। বর্তমানে নসিপুর রাজবাড়ীটি জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। এখানে বিভিন্ন পুরানো রাজবাড়ির জিনিসপত্র, কর আদায়ের বৈধ কাগজপত্র সংগ্রহ করে রাখা আছে। প্রতিবছর মহাসমারোহে ঐতিহ্য মেনে ঝুলন যাত্রা পালন করা হয়। রাজবাড়ীর উল্টোদিকে নশিপুর আখড়া রয়েছে।
এছাড়াও মুর্শিদাবাদের রয়েছে খোশবাগ, রোশনবাগ, ভবানীশ্বর মন্দির, মুর্শিদাবাদ জাদুঘর, ওয়াসেফ মঞ্জিল, জাহান কোষা ক্যানন, জাফরগঞ্জ প্রাসাদ, ওয়াসিফ মনজিল, মদিনা। সড়কপথ ও রেলপথে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী পাড়ি দিতে পারেন নতুন ইতিহাস খোঁজার উদ্দেশ্যে।
শেষের কথা
জনশ্রুতি আছে মুর্শিদাবাদ শহরে ছোট বড় মিলে প্রায় ৫৭০ টি মসজিদ ছিল, ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য ছিল ২৯৬ টি। ইংরেজদের প্রধান কেন্দ্র ছিল মুর্শিদাবাদ। লালগোলা, সুপ্রিগোলা, ভগবানগোলা, কারাগোলা প্রভৃতি জায়গা প্রাচীনকালে উল্লেখযোগ্য ছিল। ফারুকশিয়ার ফরমানেও মুর্শিদাবাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন ইতিহাসের কথা জানতে ও ইতিহাসের সঙ্গী হতে ঘুরে আসতে পারেন মুর্শিদাবাদে। অলিতে গলিতে মন্দির মসজিদ আপনাকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলবে। বেদুইনের উপকথা আজ এই পর্যন্তই।